রসূল(সঃ)-কে স্বপ্নদর্শন!একই চেহারার দুইজন ব্যক্তির স্বপ্নে আগমণ। একজন দ্বীনি ভাই তাদের প্রতি ইঙ্গিত করে জানালেন, এদের মধ্যে প্রথমজন রসূল(সঃ) এবং অপর ব্যক্তি আবু বকর(রাঃ)! আল্লাহ তায়ালা যে মহামানবকে সমস্ত সৃষ্টিজগতের নেতা করে পাঠিয়েছেন, তাঁর স্বপ্নদর্শন পাওয়া যে কোনো ঈমানদার মুসলিমের জন্যই নিঃসন্দেহে পরম সৌভাগ্যের। কিন্তু হুঁশিয়ার ঈমানদারগণ মহান আল্লাহ তায়ালার পবিত্র কালিমা পাঠ করতে থাকেন। দেখা যায় যে- আগন্তুকের সাদা পোশাক প্রথমে বেশ উজ্জ্বল দেখালেও পরক্ষণেই মলিন হতে শুরু করল! কাঁচা-পাকা শ্মশ্রুমণ্ডিত লোকটার নাকটা থেবড়া দেখালো এবং চেহারাটাও নিস্প্রভ হয়ে গেল! এটা কী করে রসূল(সঃ) হন?!সুতরাং, আগন্তুকের পরিচয়টা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেল! উচ্চস্বরে কালিমা উচ্চারণের সাথে সাথে মুখোশটা পুরোপুরি খসেপড়ল! বিতাড়িত শয়তান দ্রুত পালাতে শুরু করল...আমরা অনেকেই প্রায়ই এরকম নানান স্বপ্ন দেখে থাকি।প্রথমেই বলে রাখা ভালো, 'তথাকথিত শিক্ষিত' দাবীদার অনেকেই স্বপ্নকে কেবলই নিজের চিন্তার ফসল বলে একেবারেই গুরুত্বহীন ভেবে থাকেন। আমার আজকের এই লেখাটা সেইসব 'অতিপণ্ডিত'-দেরজন্য নয়। বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় কেবল মুসলিম-ঈমানদার ভাইদের উদ্দেশ্যেই স্বপ্ন সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার প্রয়াস করছি।মূলতঃ স্বপ্ন তিন ধরণের।১। মনের খেয়াল। (বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে- মনের পর্দায় নিজ চিন্তা বা কল্পনার প্রতিচ্ছবি)।২। শয়তানের পক্ষ হতে ভীতি প্রদর্শন।৩। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে সুসংবাদ প্রদান।[সুত্রঃ সহিহুল বুখারি, কিতাবুত তা'বির, হাদিসঃ৬৫৩৪]আমরা প্রতিনিয়ত ভালো-মন্দ দুই ধরণের স্বপ্ন দেখে থাকি। স্বপ্নের কথাগুলো আবার প্রকাশও করে ফেলি। অনেক সময় দেখা যায় যে স্বপ্নটা বাস্তবেও ফলে গেছে। যেমন কেউ একজন স্বপ্নে দেখলেন যে- একটা পরিচিত বাচ্চা পানিতে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। ঘুম থেকে জেগে স্বপ্নের কথাটা তিনি অন্যের নিকট প্রকাশ করার পর কেউ কেউ আশঙ্কা করলেন- "বাচ্চাটার পানিতে ডুবে মৃত্যু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।" দেখা গেল, পরে সত্যিই বাচ্চাটার পানিতে ডুবেই মৃত্যু হয়েছে। নিঃসন্দেহে সেটাই সেই বাচ্চাটার নিয়তি ছিল।তাহলে সেই বাচ্চাটার মৃত্যুর সাথে স্বপ্ন বা স্বপ্নের ব্যাখ্যার সম্পর্ক বা প্রভাব কী?অনেকেই এটাকে কেবল আল্লাহ্র ইচ্ছা বলেই চালিয়ে দেন। অথচ পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা যে কোন আজাব-গযবকে মানুষের নিজের 'হাতের কামাই' বা কর্মফল বলেই অভিহিত করেছেন। আমাদের কোনোভাবেই ভুলে গেলে চলবে না- শয়তান মানুষের ক্ষতি করার একটা শক্তি আল্লাহ্র নিকট থেকেই প্রাপ্ত। ফলশ্রুতিতে, দুঃস্বপ্নের মন্দ ব্যাখ্যার কারণে শয়তান সেই সুযোগটা গ্রহণ করে ক্ষতির চেষ্টা করে থাকে। এজন্যই রসূল(সঃ) আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন- "উত্তম স্বপ্ন হয় আল্লাহ্র তরফ থেকে এবং খারাপস্বপ্ন হয়ে থাকে শয়তানের পক্ষ থেকে।" [সহিহুল বুখারি, কিতাবুত তা'বির, হাদিসঃ৬৫০৩]।সুতরাং যে কোনো স্বপ্নকে কেবল নিজ চিন্তা বা কল্পনার ফলাফল বলে চালিয়ে দেয়াটা চূড়ান্ত অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু নয়। কেননা, শয়তান আমাদেরকে জাগ্রত বা নিদ্রিত সর্বাবস্থায় প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে! অবশ্য আশার কথা হলো- দুঃস্বপ্নের কথা অন্যের নিকট প্রকাশ না করা পর্যন্ত শয়তান অপকর্ম করার সুযোগ পায় না। এই প্রসঙ্গে রসূল(সঃ) আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে-"তোমাদের মধ্যে কেউ যদি এরূপ স্বপ্ন দেখে, যা তার পছন্দনীয়, তবে তা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে। তারজন্য আল্লাহ্র কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা চাই এবং তা আলোচনা করাও বাঞ্ছনীয়। পক্ষান্তরে, যদিএমন বস্তু দেখে- যা সে পছন্দ করে না, তবে তা শয়তানের পক্ষ থেকে। এরঅপকার থেকে সে যেন আশ্রয় চায় এবং কারো সাথে এ বিষয়ে আলোচনা না করে। তবে তার কোনো অনিষ্ট হবে না। [সহিহুল বুখারি, কিতাবুত তা'বির, হাদিসঃ৬৫০৪]।কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখার পর করণীয় কী হবে, এ সম্পর্কে মহানবী(সঃ) দিকনির্দেশনা দিয়ে বলেছেন,"ভালো স্বপ্ন আল্লাহ্র আর মন্দ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে। সুতরাং যে এমন স্বপ্ন দেখে- যা তার অপছন্দনীয়; সে যেন তার বামদিকে তিনবার থুতু নিক্ষেপ করে এবং শয়তান হতে (আল্লাহ্র কাছে) আশ্রয় চেয়ে নেয়, তাহলে তার আর কোনো অনিষ্ট হবে না। আর শয়তান আমার রূপ ধারণ করতে পারে না।"[সহিহুল বুখারি, কিতাবুত তা'বির, হাদিসঃ৬৫১৪]।নবীজি(সঃ) অন্যত্র আরো বলেছেন,কেউ কোনো অপছন্দনীয় বস্তু স্বপ্নে দেখলে তা অন্যের নিকট না বলে উঠে যেন নামায পড়ে। [সূত্রঃ সহিহুল বুখারি, কিতাবুত তা'বির, হাদিসঃ৬৫৩৪]।সুতরাং, স্বপ্নের তাবির সম্পর্কে কোনো ঈমানদার-মুমিন বা বিজ্ঞ আলেম ছাড়া অন্য কারো নিকট স্বপ্নের কথা প্রকাশ করা উচিত নয়। কেননা, উদাহরণ হিসেবে বাচ্চার পানিতে হাবুডুবু খাওয়া সংক্রান্ত স্বপ্নের ব্যাখ্যাটা বিজ্ঞ কোনো মুমিন ব্যক্তির নিকট বলা হলে ব্যাখ্যাটা হয়তো এরকম হতো- "এই শিশু অনেক জ্ঞানপিপাসু; একদিন সে অনেক বড় আলেম হতে পারে।" এই রকম কোনো ব্যাখ্যার কারণে শয়তানের সেখানে অংশ নেয়ার তাহলেআর কোনো সুযোগও থাকত না।হযরত ইউসুফ(আঃ) স্বপ্নের বিষয় তাঁর পিতার নিকট প্রকাশ করলে,"জবাবে পিতা বললেন, হে পুত্র! তোমার এ স্বপ্নের কথা তোমার ভাইদের নিকট বলবে না। তাহলে তারা তোমার বিরুদ্ধে বড় ধরণের চক্রান্ত করবে; সত্য হল- শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।" [সূরাঃ ইউসুফ, আয়াতঃ৫]।শয়তান কিন্তু তখনই পিতা-পুত্রের এই আলাপচারিতা শুনে ফেলল এবং ইউসুফ(আঃ)-এর অন্যভাইদের জানিয়ে দিলে তারা শয়তানের প্ররোচনায় তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।অনেকসময় শয়তান আমাদেরকে অশ্লীল,অনৈতিক কর্মকান্ড বা হত্যার মতোকোনো ভীতিকর অবস্থা প্রদর্শনপূর্বক সন্ত্রস্ত্র করে ঈমান হরণের চেষ্টা করে থাকে। এই প্রসঙ্গে হযরত জাবির(রাঃ)-এর সুত্রে বর্ণিত-"একদা এক বেদুঈন তাঁর (রসূল সঃ-এর) কাছে আগমন করে বলল, আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমার মাথা কেটে ফেলা হয়েছে, আর আমি তার পেছনে পেছনে ছুটে চলছি। তখন রসূলুল্লাহ(সঃ) তাকে ধমক দিয়ে বললেন, ঘুমের মাঝে তোমার সঙ্গে শয়তানের খেলাধূলার সংবাদ কাউকে দিও না।" [সহীহুল মুসলিম, স্বপ্ন পরিচ্ছদ, হাদিসঃ৫৭৭১]।আবার শয়তান অনেক সময় আলেমের ছদ্মবেশ নিয়েও মুমিনদের ক্ষতি করার অপচেষ্টা করে থাকে। অনেক সময় নবীজি(সঃ)-এর রূপ ধারণের ব্যর্থ চেষ্টাও করতে পারে। তবে যারা নবীজি(সঃ)-এর সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করার চেষ্টা করে, শয়তান তাদের কাছ থেকে ব্যর্থ হয়েই পালিয়ে যায়।রসূল(সঃ) বলেছেন, "যে আমাকে স্বপ্নে দেখবে, সে সত্যই দেখবে। কারণ, শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে পারে না এবং ঈমানদারের স্বপ্ন নবুয়তের ছিচল্লিশ ভাগের এক ভাগ।" [সহিহুল বুখারি, কিতাবুত তা'বির, হাদিসঃ৬৫১৩]অতএব, শয়তান যেন রসূল(সঃ)-এর রূপ ধারণের ব্যর্থ চেষ্টা করে কোনভাবেই আমাদেরকে চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে, সেজন্য আমাদের উচিত, রসূল(সঃ)-এর সীরাত সম্পর্কে জানা এবং সেইমতো নিজেকে তাঁর প্রকৃত উম্মত হিসেবে পরিণত করারচেষ্টা করা। সেই সাথে শয়তানের প্রভাবমুক্তির জন্য আল্লাহ্র শেখানো এই দোয়া (সূরা নাস) পাঠ করতে থাকি-"আশ্রয় চাই তোমার কাছে, হে মানুষের রব!তুমি মালিক, আমরা তোমার সৃজিত মানব।হে মানুষের মহামহিম ইলাহ, মেহেরবান,করছে বিনাশ কুমন্ত্রনায় ভয়ানক শয়তান!লোকের কানে যুক্তি দিয়ে হয়ে যায় অচিন,কভু সফল হয় না যেন- দুষ্ট মানুষ, জ্বিন।'[কাব্যে আল-কুরআন, খন্ডঃ৩০, সুরাঃ না-স,